আকাশের খুব কাছ থেকে…..
ফিরোজা
আকাশের তলায় এক পাহাড় দু পাহাড় বেয়ে ওঠা। এখানে সেখানে রোদ-কুয়াশার লুকোচুরি
দেখি রোজ। আমিও খেলি! লুকোনোর সবচেয়ে ভালো জায়গা—ভরা চা-বাগান। আমার প্রচুর বন্ধু এখানে…বিজ্জি,নীলম,রামাঙ্গা..আরও
অনেকে। বিজ্জিই আমাকে এখানে নিয়ে আসে প্রথম। ও বলে এখানে নাকি ঈশ্বর বাস করেন…আমি
বলি এখান থেকে স্বর্গ দেখা যায়!
আকাশও যখন কুয়াশা আর
মেঘের ফারাক বোঝেনা, আমরা তখন আলোর খোঁজে বয়ে চলি
এস্পার ওস্পার। শরীর জুড়ে শুধুই “ছেঁড়া-ফাটা” অথবা “ধার করা” কাপড়,আর ফ্যাক্টারি থকে পাওয়া একটা ঝুড়ি। আমি ইচ্ছে করে মাথায় একটা ফেট্টি
মত বাঁধি…বিজ্জি
হাসে! পৃথিবীর উচ্চতম চা-বাগানের কর্মী আমরা। লোকে বলে সাত হাজার একশ ফুট…আমি বলি,আমার খেলাঘর...দিন-রাত্রি
যেখানে ইচ্ছেমত জাগে-ঘুমোয়...পরিসীমার বেড়াজাল নেই যেখানে...আছে শুধুই সবুজ,সবুজ আর সবুজ...
সেই সবুজকে সঙ্গী করে
প্রত্যেকদিন সকাল সাড়ে ছ-টায় আমরা বেরোই চা পাতা তুলতে। মাস গেলে হাতে জোটে দেড়
হাজার...আর পায়ে জোটে কারো ব্যান্ডেজ,কারো হাজা আর কারো তো
পা-ই...হু!যাকগে!
এখানে রাস্তা নেই। কোনোক্রমে
পাথর কেটে রাস্তা বানানোর প্রচেষ্টাটুকু চোখে পড়ে। হাঁটলে পা যাব
যাব...ফ্যাক্টরির ট্র্যাক্টরে গেলে শরীর যাব যাব... তবুও তো, মাস গেলে দেড় হাজার-কে দেবে বল?
রাস্তা ছাড়ো... যখন
চালতা ভাতের গন্ধে গা শিউড়ে ওঠে,তখন এ পাহাড় সে জঙ্গল থেকে ঐ
যে হলুদ-কালো জমকালো জন্তুটা... সেও এ সবুজে এসে আস্তানা গড়ে। এই তো কিছুদিন
আগে...সবাই পালাল ছুটে,আমিও পালালাম...বিজ্জিটা শুধু হোঁচট
খেয়ে পড়ল এই পাথুরে রাস্তায়...চিতাটা এসে ওর পা-টা কামড়ে ধরেছিল...তারপর কি
থেকে কি হল মনে নেই...ঈশ্বরের দেশেও তো লড়তে হয়। বিজ্জির ডান পা-টা এখন আর
নেই...
আজ চার্চে গেছিলাম বিজ্জির জন্য
প্রার্থনা করতে। এসে ওর খাবার বানিয়ে আবার ঝুড়ি সমেত উঠে এলাম আমার প্রিয়
খেলাঘরে। আজ আবার এখান থেকে স্বর্গ দেখা যাচ্ছে। লাল রঙের সেই আলোটা মেঘেদের হার
মানিয়ে আমার মুখের ওপর এসে পড়ছে...তিন দিন ঝোড়ো বৃষ্টির পর আজ আবার একটা নতুন
ফিরোজা আকাশ...চা বাগান ভরেছে ঘন সবুজের ওপর হাল্কা তিনকড়ি সবুজ পাতায়। চা পাতা
তোলার কাজ শুরু হোক। হাত দিয়ে দেখি...আহ! কি নরম...আর তারপরেই ঝাপটা...
"ফোঁসসসস..."
আহ! পারছিনা...আর পারছিনা...সব
কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে...তবু আমি স্বর্গ দেখতে পাচ্ছি...এখনও... চোখ বুজে আসছে...
আকাশের খুব কাছ থেকে... নিস্তব্ধতা ভেসে আসছে...
লিখলেন সঙ্গীতা
No comments